“আহা!” আড়ালে থাকা বাংলা চলচ্চিত্রের অসামান্য সৃষ্টি।



“আহা!” পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র। ২০০৭ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ৪টি বিভাগে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পায়। প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পীদের সমাগম হয়েছে চলচ্চিত্রে, যাদের অসামান্য অভিনয় চলচ্চিত্রটিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবিক করে তুলেছে। হুমায়ুন ফরিদী, ফজলুর রহমান বাবু, তারিক আনাম, প্রত্যেকেই নিপুণভাবে নিজেদের চরিত্র রুপায়ন করেছেন। গল্পের মূল চালিকাশক্তি এর বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা ও সংলাপ। খাপছাড়া, অতিরঞ্জিত সংলাপের ছড়াছড়ি এতে নেই। ১২৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময় দর্শকের মনোযোগ ও আগ্রহ অটুটভাবে ধরে রাখে।

শতবছরের পুরনো বাপ-দাদার বাড়িতে একা বাস করেন ‘মল্লিক সাহেব’। বাড়িতে অন্যলোক বলতে কেবল বাবুর্চি ‘রতন’ আর কর্মচারী ‘মোখলেস’। ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় অপরুপ কারুকার্যের, শেওলা জমা, ধূসরবর্ণের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। আশেপাশের বাড়িগুলো রিয়েল এস্টেট কোম্পানী’র দৌরাত্বে আট-দশতলা দালানে রূপ নিয়েছে। নানা প্রলোভনে এই বাড়িটিও এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স বানানোর ফন্দি আঁটছে তারা। বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে মল্লিক সাহেবকে রাজি করাতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ডেভলপার ‘রফিক’ । নতুন নতুন প্রস্তাব নিয়ে ধরনা দিচ্ছেন তাঁর বাড়িতে।


মল্লিক সাহেবের একমাত্র মেয়ে ‘রুবা’ আমেরিকা প্রবাসী। বাবার আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মুখবুজে সহ্য করছিল রুবা। শেষমেশ নিজের কাছে হেরে গিয়ে ৬ বছরের ছেলে ‘বুবা’কে নিয়ে দেশে ফেরে ‘রুবা’। এসে উঠে বাবার শীর্ণপ্রায় বাড়িটিতে।

দীর্ঘদিন পর নারীর পদচারণায় খানিকটা প্রাণ পেল বাড়িটি। পুরনো বাড়িতে একপ্রকার আবদ্ধ জীবন যাপন শুরু হয় রুবা’র। এঘর ওঘর হাঁটাহাঁটি আর ব্যস্ত শহর দেখে সময় কাটে তার। মাঝে মাঝে জানালার ফাঁক গলিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করে। চোখে পড়ে নতুন গজিয়ে ওঠা বিল্ডিং আর সারি সারি বারান্দা। বর্ষায় একদিন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ পাশের বারান্দায় আবিস্কার করে এক লাল ‘আন্ডারগার্মেন্টস’। দিন বদলের সাথেসাথে আন্ডারগার্মেন্টসের রঙ বদলায়। পরপর সাতদিন সাত রঙের আন্ডারগার্মেন্টস ঝুলতে দেখে তার কৌতূহল বাড়ে, মনে উঁকি দেয় এক অদ্ভুত রহস্যের!!


আন্ডারগার্মেন্টসের মালিক ‘কিসলু হাসান’ বারান্দা থেকে লক্ষ্য করেন রুবাকে। পঞ্চাশোর্ধ’র মনে রোমাঞ্চ দোলা দিয়ে ওঠে। বুবা’র খৎনার দাওয়াতে এসে প্রারম্ভিক পরিচয় পর্বটা সেরে নেন কিসলু সাহেব। বারান্দায় এখন প্রায়শই চোখাচোখি হয় দু’জনার। টেলিফোনে চলতে থাকে কৌতুকপুর্ণ, সরস আলাপন।

সকলের আপত্তিতে বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না মল্লিক সাহেব। স্থানে স্থানে পড়ে গেছে বাড়ির পলেস্তার। ইট খসে পড়ছে পিলার থেকে। দেয়াল ফেটে গেছে কয়েক জায়গায়। এবাড়িতে বাস করা এখন ঝুঁকিপুর্ণ। তারপরও বাড়িটি স্মৃতির মায়ায় আবদ্ধ করে রেখেছে এর বাসান্দিদের। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ছোটবেলার, বড় হয়ে ওঠার স্মৃতি।

বাড়ির কর্মচারি মোখলেস বড় অদ্ভুত চরিত্র। বাংলাদেশের ক্রিকেট তার আগ্রহের মূলবিন্দু। ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্তরোত্তর ব্যর্থতায় মোখলেস খুবই ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ মিটিয়ে নেয় রাস্তায় ক্রিকেট খেলারত ছোকরাদের মারধোর করে। ফলে পাড়ার ছেলেদের সাথে প্রতিনিয়তই ‘টম এন্ড জেরি’ খেলা চলে মোখলেসের।

স্বামীকে ছেড়ে আসায় রুবার মন খারাপের দিনগুলো এখন ভাললাগায় পূর্ণ হতে লাগল। কষ্ট ভুলে বেঁচে থাকার, মনটাকে জিইয়ে রাখার একটা অবলম্বন সে পেল। মানসিক কষ্টে পিষ্ট হওয়া মনটা সুখের আশায় ছিল তৃষ্ণার্ত। একসাথে ঘুরতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান কিসলু। দুজনে ঘুরে দেখল লালবাঘ কেল্লা, বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকা শহরের কিছু যায়গা। কিসলু সাহেবের মুখে অজানা ইতিহাসগুলো অভিভূত হয়ে শুনছিল রুবা। অনেকদিন পর মুক্তবাতাসে শ্বাস নিল সে। আলাপচারিতা আর মুহুর্তগুলো বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে দুজনার। সম্পর্ক হয়ে ওঠে আরো গাঢ়, আরো গভীর……!!



চলচ্চিত্রটি সময়ের পরিবর্তনে সনাতন সামাজিকরীতি থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয়। বাস্তব জীবনে মানুষের ‘স্ববিরোধিতা’ নীতিকে প্রশ্নবিদ্য করে। চরিত্রগুলোর মাঝে প্রচণ্ডরকম অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এমনকি বিভিন্ন চরিত্রের মাঝে ব্যক্তত্বের সঙ্ঘাতও প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। চলচ্চিত্রের একটা সংলাপ,
“আমি শেয়ার বাজার করি বলে কি কবিতা লিখতে পারব না? আরে যার চরিত্রে যত বেশী contrast, তার চরিত্রই তো তত বেশী interesting!”

আমেরিকা ফেরত রুবা স্বাভাবিক ভাবেই প্রগতিশীল, প্রচলিত সামাজিক রীতির তোয়াক্কা করেনা। সম্পর্ক কিংবা ছেলের খৎনার প্রশ্নে সে যতটুকু আধুনিক, বাড়ি ভাঙার প্রশ্নে তার মতামত ততটুকুই সনাতন। একই রকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট মল্লিক সাহেব চরিত্রটিতেও। সামাজিক মর্যাদা যার কাছে প্রিয় মানুষের সুখ ও সম্মানের চেয়ে বেশী গুরুত্ব পায়। মোখলেস চরিত্রটিতেও পরস্পর বিপরীতমুখী মানব চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। সে ক্রিকেট খেলা পছন্দ করে কিন্তু পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট খেলা তার পছন্দ না।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক মানেই গোপন প্রেম নয়। বরং তাদের মাঝে অনেক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন, বন্ধুত্ব কিংবা নিছক সময় কাটানোর জন্যও অনেক সম্পর্ক তৈরী হয়। সম্পর্কের মাঝে যখন শ্রদ্ধা, ভালবাসা যোগ হয় সেটি তখন অনন্য মর্যাদা পায়। সম্পর্কের অনেকগুলো প্যাটার্ন; সব সম্পর্ককে এক প্যাটার্নে ফেলা বড় অন্যায়। আমাদের পরিবার, সমাজ এই সম্পর্কটাকে কখনোই ভাল চোখে দেখেনি। আমরা নিজে প্রেম করি, কিন্তু আপন বোন যাতে অন্য ছেলের সাথে প্রেম করতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করি। আমরা পরিবর্তন চাই কিন্তু পুরাতনকে আঁকড়ে থাকতেই বেশী পছন্দ করি।

“আহা!” ২০০৭ সালে নির্মিত পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝরের প্রথম কাজ। ছবিটির চিত্রনাট্য এবং সঙ্গীত রচয়িতাও তিনি। হুমায়ূন ফরিদী, ফজলুর রহমান বাবু, শহিদুল ইসলাম সাচ্চুর মত প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা চরিত্রগুলোতে প্রাণ সঞ্চার করেছে যা চলচ্চিত্রটির প্রতি তাদের মমতা ও দায়বদ্ধতারই পরিচয় বহন করে। বেশীর ভাগ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ ৩/৪ টি চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত ও যোগ্য অভিনয়শিল্পীদের নির্বাচন করা হয়, কিন্তু অন্যান্য শিল্পীদের দুর্বল অভিনয়ের কারণে অনেক সময় চলচ্চিত্রগুলো ন্যূনতম মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রটি এই দোষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। এখানে প্রতিটি চরিত্রকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। ডেভেলপার রফিকের ছোট্ট চরিত্রটি ফুটিতে শহিদুল ইসলাম সাচ্চু যে পরিমাণ ডেডিকেশন দিয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয়।

রুবা ও কিসলুর ফোনালাপের সংলাপগুলো অত্যন্ত প্রাণবন্ত, সরস ও পরিমিত। দু’লাইন বলার পর, “বাহ্‌! আপনি তো অনেক সুন্দর কথা বলতে পারেন” এমন অতিকথন এতে নেই। সাজু খাদেম আর হুমায়ূন ফরীদির মধ্যকার কথোপকথন ছিল মুভির চুম্বক অংশ। কৌতুকময় সংলাপ ও বাচনভঙ্গির এত সাবলীল অভিনয় সচরাচর দেখা যায়না। মনে হয় যেন রিয়েল লাইফে কথা বলছেন।

এই চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রের কথা বলার ধরণের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন রফিক সাহেব চাপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা এবং স্বভাবতই তার কথায় রাজশাহীর টান লক্ষ্য করা যায়। মল্লিক সাহেবের পাড়ার ছেলেরা পুরান ঢাকাবাসীর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে কথা বলে। আসিফ আর রুবাকে প্রচুর ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়।


ছবিটি সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম এর গানের মাধ্যমে। “লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প” ফাহমিদা নবির এই জনপ্রিয় গানটি এই ছবির মূল গান। গানগুলোতেও সার্থকভাবে অনুরণিত হয়েছে মূল চরিত্রগুলোর বিষাদ ও বিষন্নতা যা চলচ্চিত্রের মূলভাবকে আরো পরিণত ও জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছে।

পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকা, লালবাগের কেল্লাসহ ঢাকা শহরের কিছু জায়গার চমৎকার দৃশ্যায়ন হয়েছে এতে। পুরান ঢাকার কিছু সংস্কৃতি উঠে এসেছে এর মাঝে। পুরো চলচ্চিত্রটি ধারণ করে হয়েছে ৩৫মি.মি. ফরমেটে। ডিজিটাল ক্যামেরায় হলে আরো ভাল হত।
৪টি বিভাগে শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ‘আহা!’ছবিটি প্রায় আড়ালেই রয়ে গেল। চলচ্চিত্রটি নিয়ে কাউকে খুব একটা লিখতে দেখিনি। ইউটিউবের একটা লিংক ছাড়া ভাল কোন প্রিন্টও খুঁজে পাইনি। গল্পের নায়িকা সাথী ইয়াসমিন সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাইনি। অথচ কোনকিছুর কমতি ছিলনা ছবিটিতে। দেশের সেরা দশটা মুভির তালিকা করলে তার মাঝে এটি একটি। একসাথে গল্প, অভিনয় এবং সঙ্গীতের এত চমৎকার সংযোজন খুব কম দেখা যায়। শতবছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে প্রতিনিধিত্ব করা ছবি এটি। এমন অসামান্য সৃষ্টিকর্মগুলো সমর্থন না পেলে ভালকাজের সৃষ্টি আর হবেনা। এর সংলাপের মত করে বলতে হয়, “ইউরোপের দেশগুলোতে পেট্রোনাইজেশন আছে, আমার দেশে তা নাই”।

ছবিটি সরাসরি দেখার লিঙ্কঃ 


No comments

Powered by Blogger.