দুঃখ নিওনা সুন্দরবন, আমরা এমনই!!

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানা ঘুর্নিঝড় সিডরের কথা সবার মনে আছে নিশ্চয়ই। রাত ৯টায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে এটি। রেডক্রসের হিসেব অনুযায়ী এতে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশী ছাড়িয়ে যায়। ৩১ টি জেলার ২১০ টি উপজেলায় প্রায় ৮০ লক্ষেরও বেশী মানুষ সিডরের কবলে পড়ে। সাড়ে ১২ লক্ষেরও বেশী গবাদি পশু মারা যায়। সম্পুর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০ হাজারেরও বেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারন করা হয় ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এখনও সিডর আক্রান্তদের পুরোপুরি পুনর্বাসন হয়নি।

২০০৯ সালের ২১ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘুর্ণিঝড় আইলা উপকূলে আঘাত হানে ২৫ মে তারিখে। এর ব্যাস ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার; সিডর থেকেও ৫০ কিলোমিটার বেশী। সিডরের মতই আইলা প্রায় ১০ ঘন্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। তবে বাতাসের বেগ ৮০-১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি, সিডরের তুলনায় কম হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের এক বছর পর পত্রিকায় প্রকাশিত হিসেব অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণঃ
- প্রায় ২,০০,০০০ একর কৃষিজমি লোনা পানিতে তলিয়ে যায় (৯৭ হাজার একরের আমন ক্ষেত সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়)
- কাজ হারায় ৭৩,০০০ কৃষক ও কৃষি-মজুর
- জলোচ্ছাস ও লোনা পানির প্রভাবে, গবাদি পশুর মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ গরু ও ১,৫০০ ছাগল মারা যায়
- কমপক্ষে ৩,০০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় (২,৪৩,০০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়)
- পর পর দুই মৌসুম কৃষিকাজ না হওয়ায় প্রায় ৮,০০,০০০টন খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি হয়।
-  খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্রাণ হারান ১৯৩ জন মানুষ।



সিডর আইলার মত এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঢালের মতই উপকূলীয় এলাকাকে আগলে রাখে সুন্দরবন। প্রলয়ঙ্করী এ দুটি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি উপকূলবাসী এখনো কাটিয়ে উঠতে না পারলেও সেই ধাক্কা সামলে সুন্দরবন ঠিকই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। সুন্দরবনের কারণে সিডর ও আইলা মানববসতি এলকায় আসার আগেই অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সিডর ও আইলার পর আবহাওয়া বিভাগ থেকে জানানো হয়, সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কাটা আসত খোদ রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি প্রতিঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার থেকে কমে ২০০ কিলোমিটারের নিচে নেমে গিয়েছিল। সুন্দরবনের কারণে আইলার বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছাসের উচ্চতা চার ফুট কমে গিয়েছিল। নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সুন্দরবন রক্ষা করেছিল মানুষের জীবন ও সম্পদ।

পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এই সুন্দরবন। একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। সেখানে বাংলাদেশের আছে মাত্র ১৩ ভাগ। যার সবচেয়ে বড় একটি অংশ পুরণ করছে একক সুন্দরবন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়, বন্য প্রাণীর বৈচিত্র রক্ষায় এবং বাস্তুসংস্থানে বিশেষ ভুমিকা রাখছে চিত্রা হরিণের চারণ ক্ষেত্র এই সুন্দরবন।


সম্প্রতি বাঘেরহাটের রামপালে ভারতের সাথে যৌথ সহযোগিতায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প করার চুক্তি সম্পন্ন করেছে সরকার। প্রকল্পটিতে সমান অংশীদার ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানীর। ১৩২০ মেগাওয়াটেরই একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তারা মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার ঝিকলি-তুমরা গ্রামে করতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি বিবেচনায় তারা পারমিশন পায়নি। এই প্রকল্পে ভারতের লাভ আর আমাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। তারা এই প্রকল্প থেকে যা আয় করবে তার জন্য কোনো কর শোধ করতে হবে না। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০% বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋন আনা হবে।আনয়নকৃত ঋনের সমস্ত সুদ বহন করবে বাংলাদেশ।বাকি ৩০% ব্যয়ের ১৫% বহন করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়াত্ত বৈদ্যুতিক প্রতিষ্ঠান পিডিবি এবং ১৫% ভারতীয় রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি।

প্রকল্পের লাভ ভাগ হবে ঠিক সমান হারে!৫০% বাংলাদেশ, বাকি ৫০% ভারতীয় এনটিপিসি! আবার এই ৭০% বিদেশী ঋণ ভারতই দিচ্ছে উচ্চ সুদহারে।

বালাদেশী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ দেশে তিনটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করছে। তার মধ্যে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে ৪ টাকা প্রতি ইউনিট ও খুলনার লবনচড়া এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্ল্যান্ট থেকে ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হবে।অথচ রামপাল থেকে একই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমরা কিনবো ৮ টাকা ৮৫পয়সা দরে!!!
দ্বিগুনেরও মাত্র বেশী কিছু টাকা।


ভারতের “ভোপাল আইআইটি” থেকে পাশ করা মেকানিক্যাল এন্ঞ্জিনিয়ার, ভারতীয় নাগরিক “জায় শারদা”, পেশায় একজন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার, হাফিংটন পোস্টে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ফলে বাংলাদেশ, সুন্দরবন ও পরিবেশ কী কী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে সে সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আর্টিকেল লিখেছেন। আর্টিকেলের একপর্যায়ে তিনি লেখেন, 
"ইনডিয়ান সরকার এমন এক সময়ে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে,যখন তারা নিজেরাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ইনডিয়া এর মাঝেই তাদের উচ্চাভিলাষী রিনিউয়েবল এনার্জি প্রোগ্রামে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে ২০২২ সালের মাঝে ১৭৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ রিনিউয়েবল এনার্জি সেক্টর থেকে উৎপাদন করা। একইসাথে, ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী এটাও পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, ইনডিয়া আমদানীকৃত কয়লার ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনবে, কারণ ইনডিয়ান কয়লাভিত্তিক বিদ্যূটকেন্দ্রগুলো ৬০% লোড ফ্যাক্টরের নিচে কাজ করে।"

একটি প্রকল্পের ৮৫ ভাগ অর্থ নিজেরাই যোগান দিয়ে, বৈদেশিক ঋণের পুরো সুদ নিজেরাই পরিশোধ করে, স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে, সকল প্রকার ক্ষতির দায় নিজেরাই বহন করে, নিজেদের বনভূমি, জীব-বৈচিত্র ও পানি সম্পদ ধ্বংস করে এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কোন মানেই হয় না।

হ্যাঁ, বিদ্যুৎ আমাদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু দূষণমুক্ত পরিবেশ তারচেয়ে বেশী দরকার। দূষিত পরিবেশে বাঁচতে না পারলে বিদ্যুৎ দিয়ে হবেটা কী??


No comments

Powered by Blogger.